সুপ্রবুদ্ধ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে পালিয়ে থাকলেও মৃত্যুর কবল হতে মুক্তি নেই”
সাধনাজ্যোতি ভিক্ষু
অত্যন্ত সুপরিচিত ঘটনা এটি—যখন রাজকুমার সিদ্ধার্থ গৃহত্যাগ করে সত্য অনুসন্ধানে যাত্রা করেন, তখন তাঁর এই সিদ্ধান্তে একপ্রকার অসন্তুষ্ট হন শাক্য বংশের অনেকেই। তবে যিনি সবচেয়ে বেশি বিরক্ত ও ক্রুদ্ধ হন, তিনি ছিলেন রাজকুমার সিদ্ধার্থের মাতুল ও পরবর্তীতে শ্বশুর—রাজা সুপ্রবুদ্ধ শাক্য।
তিনি ভাবতেন,
— “এই সিদ্ধার্থ আমার কন্যা যশোধরাকে ত্যাগ করে বনে গেছেন, সংসার ও রাজত্ব ছেড়েছেন, এখন নিজেকে ‘বুদ্ধ’ বলে প্রচার করছেন! আবার আমার নাতি, দেবদত্তকে প্রব্রজ্যা দিয়ে তাকে নিজের প্রতিদ্বন্দ্বী বানিয়ে তুলেছেন।”
এমনটাই ছিল সুপ্রবুদ্ধের মানসিক অবস্থা। অন্তরে চেপে বসেছিল বুদ্ধের প্রতি এক গভীর বিদ্বেষ। তাঁর অহং ও পারিবারিক অপমানবোধ একত্র হয়ে তাকে ধীরে ধীরে অন্ধ করে দিচ্ছিল।
একদিন গ্রীষ্মের এক সকালে বুদ্ধ ভগবান ও ভিক্ষুসংঘ রাজগৃহ নগরীতে এক ধনী গৃহস্থের নিমন্ত্রণে গৃহভোজনের উদ্দেশ্যে যাত্রা করছিলেন। সেই সংবাদ পেয়ে রাজা সুপ্রবুদ্ধ ক্রুদ্ধ হয়ে উঠলেন। তিনি সেই বুদ্ধকে ব্যক্তিগত অপমানের প্রতীক মনে করতেন।
তিনি বললেন,
— “আজ আমি দেখিয়ে দেব, আমার পথ আমি কেমনভাবে রক্ষা করি! আজ তিনি আহার করতে পাবেন না!”
সেই চিন্তা থেকেই সুপ্রবুদ্ধ মাতাল হলেন। অশ্লীল ভাষায় চিৎকার করতে করতে তিনি বুদ্ধের যাত্রাপথে এসে দাঁড়ালেন এবং ভিক্ষুসংঘকে থামিয়ে দিলেন। তাঁর চোখ ছিল রক্তবর্ণ, আচরণ ছিল বেপরোয়া।
বুদ্ধ নির্বাকভাবে এই অবস্থা পর্যবেক্ষণ করলেন। তিনি জানতেন—সুপ্রবুদ্ধ তাঁর কৃতকর্মের ফল নিজেই সংগ্রহ করবেন। তখনই বুদ্ধ একটি ভবিষ্যদ্বাণী করলেন,
— “এই সপ্তাহের মধ্যেই, সপ্তম দিনে, রাজা সুপ্রবুদ্ধের মৃত্যু অনিবার্য। তাঁর প্রাসাদের নিম্ন সোপানতলে পৃথিবী তাঁকে জীবন্ত গ্রাস করবে।”
এই কথা শুনে পুরো রাজগৃহে চাঞ্চল্য ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু রাজা সুপ্রবুদ্ধ বুদ্ধের এই ভবিষ্যদ্বাণী শুনে হেসে উঠলেন।
তিনি বললেন,
— “আমাকে মাটির নিচে যেতে হবে? তা হতেই পারে না! আমি সারা সপ্তাহ প্রাসাদের উপর তলেই চলাফেরা করব। নিচে যাব না—দেখি কে আমাকে গ্রাস করে!”
সপ্তাহ কেটে যাচ্ছিল। প্রতিটি দিন তিনি সতর্ক ছিলেন, প্রাসাদের নিম্ন সোপানে যেতেন না। এমনকি রাতে পাহারা বসিয়ে রেখেছিলেন, যেন কেউ তাঁকে ভুল করে নিচে না নামিয়ে আনে।
কিন্তু সপ্তম দিন, ভাগ্য তার গোপন যবনিকা খুলে দেয়। এক আকস্মিক দরবারী চক্রান্তের ফলে এক গুরুত্বপূর্ণ দলিলপত্রে স্বাক্ষর দিতে তাকে নিম্ন তলায় আসতে বাধ্য করা হয়। এবং ঠিক সেই মুহূর্তে, প্রাসাদের মাটি ফেটে যায়। গর্জন তুলে পৃথিবী যেন আপন শক্তিতে তাঁকে টেনে নেয়।
রাজা সুপ্রবুদ্ধ জীবন্ত গ্রাসিত হলেন—এই পৃথিবীই তাঁর কৃতকর্মের সাক্ষী রইল এবং তাকে আপন কোলে টেনে নিল।
পরদিন, রাজগৃহের নিগ্রোধারামে একত্রিত হয়েছিলেন অনেক ভিক্ষু। তাঁরা এই আশ্চর্য ঘটনার আলোচনা করছিলেন। কেউ বিস্মিত, কেউ শঙ্কিত, কেউ আবার কৌতূহলী।
তাঁরা বুদ্ধকে প্রশ্ন করলেন,
— “হে ভগবান, সত্যিই কি কেউ মৃত্যুর হাত থেকে পালাতে পারে না? যদি সে আকাশে উঠে, সমুদ্রের গভীরে লুকায়, কিংবা পাহাড়ের গুহায় আশ্রয় নেয়?”
বুদ্ধ মৃদু হাসলেন। তাঁর মুখে ছিল প্রশান্ত এক দীপ্তি। তিনি বললেন,
“ন অন্তলিক্খে, ন সম্মুদ্দমজ্ঝো,
ন পব্বতানং বিবরং পবিস্স,
ন বিজ্জতি সো জগতিপ্পদেসো,
যত্থট্ঠিতো মুঞ্চেয্য মচ্চু।”
(ধম্মপদ ১২৮)
এর অর্থ—
“আকাশের উচ্চতায়, গভীর সমুদ্রের গর্ভে কিংবা পাহাড়ের গুহার মধ্যে—জগতের এমন কোনো স্থান নেই, যেখানে অবস্থান করলে কেউ মৃত্যুর কবল থেকে রক্ষা পেতে পারে না।”
বুদ্ধ আরও বললেন—
“জন্ম যেহেতু ঘটেছে, মৃত্যু এক অবধারিত পরিণতি। মৃত্যুকে ঠেকানো যায় না বাহ্যিক আশ্রয় দিয়ে। একমাত্র ‘তৃষ্ণার সম্পূর্ণ ক্ষয়’ ঘটলেই মৃত্যুর বন্ধন ছিন্ন হয়। যার ভিতরে মোহ নেই, ক্রোধ নেই, আসক্তি নেই, সেই চিত্তই অমৃতের পথে পদার্পণ করে।”
গল্পের শিক্ষা:
এই কাহিনী আমাদের শেখায়—মৃত্যু অবধারিত। কেউই তার হাত থেকে রেহাই পায় না, যতই প্রতিরোধ বা গোপন চেষ্টাই করুক না কেন।
শুধু বাহ্যিক শক্তি বা রাজকীয় প্রতাপ দিয়ে নয়, আত্মিক সাধনা ও চিত্তশুদ্ধির মাধ্যমে তবেই চির শান্তি ও মুক্তি লাভ সম্ভব।
কারণ, মৃত্যুর হাত থেকে পালাবার পথ নেই—তবে মুক্তি আছে সেই মৃত্যুকে অতিক্রম করার, তার পরেও কিছু অর্জনের—আর সেটাই হলো নির্বাণ।
