Loading Logo

Загрузка..

6183 Точки 2 w ·перевести

**অহংকার ও ধ্বংসের প্রলয় - বিড়ূঢ়ভের করুণ পরিণতি**

একসময় কোশল রাজ্যে শাসন করতেন মহারাজ প্রসেনজিৎ। তাঁরই পুত্র ছিলেন রাজকুমার বিড়ূঢ়ভ। বিড়ূঢ়ভের হৃদয়ে লুকিয়ে ছিল গভীর এক ক্ষোভ, এক অসহনীয় অপমান। কারণ, শাক্যবংশীয়রা, যারা জ্ঞানে ও বংশমর্যাদায় নিজেদের উচ্চ বলে মনে করত, তারা একবার মহারাজ প্রসেনজিতের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করলেও, তাদের এক দাসীকন্যাকে শাক্য রাজকন্যার পরিচয়ে পাঠিয়ে প্রসেনজিৎকে প্রতারণা করেছিল। এই সত্য যখন উদঘাটিত হলো, বিড়ূঢ়ভ নিজেকে এবং তাঁর পিতাকে চরমভাবে অপমানিত বোধ করলেন। সেই অপমানবোধ ধীরে ধীরে তাঁর মনে প্রতিশোধের অগ্নি প্রজ্বলিত করল।
দীর্ঘদিন ধরে তিনি এই অপমানের জ্বালা বুকে পুষে রেখেছিলেন। পিতা প্রসেনজিতের মৃত্যুর পর বিড়ূঢ়ভ যখন কোশলের সিংহাসনে আরোহণ করলেন, তাঁর প্রতিশোধস্পৃহা আর বাঁধ মানল না। বিপুল সৈন্যবাহিনী নিয়ে তিনি শাক্যরাজ্যের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন। সেই আক্রমণ ছিল ভয়াবহ, পৈশাচিক। শাক্যদের অহংকার চূর্ণ করার নেশায় উন্মত্ত বিড়ূঢ়ভ সমগ্র রাজ্যে রক্তের বন্যা বইয়ে দিলেন। বৃদ্ধ, নারী, শিশু – কেউ বাদ গেল না তাঁর জিঘাংসার হাত থেকে। শাক্যরাজ্যকে ধূলিসাৎ করে, নিজের অপমানের চরম প্রতিশোধ গ্রহণ করে বিড়ূঢ়ভ যখন জয়ের নেশায় মত্ত হয়ে উঠলেন, তাঁর হৃদয় তখন কেবলই পৈশাচিক উল্লাসে ভরে ছিল।
বিপুল ধনসম্পদ আর বন্দী নিয়ে তাঁর বিজয়িনী বাহিনী কোশলের রাজধানী শ্রাবস্তীর দিকে ফিরে চলছিল। দীর্ঘ যাত্রার ক্লান্তি দূর করতে এবং নিজেদের বিজয় উদযাপনের জন্য তাঁরা অচিরবতী নদীর মনোরম তীরে শিবির স্থাপন করলেন। গোধূলির আলো যখন ফিকে হয়ে আসছিল, বিড়ূঢ়ভ এবং তাঁর সৈন্যরা তখন চরম প্রমোদে মত্ত হয়ে উঠল। সুরার নেশা আর ভোগবিলাসের অন্ধত্ব তাদের আচ্ছন্ন করে ফেলল। তারা ভুলে গেল এই পৃথিবীর অনিশ্চয়তা, ভুলে গেল প্রকৃতির রুদ্ররূপ। বিজয়গর্বে, ভোগবাসনায় আকণ্ঠ নিমগ্ন হয়ে তারা গভীর রাতে সুপ্তির কোলে ঢলে পড়ল। নদীর স্নিগ্ধ বাতাস, শিরে সুরার ঘোর – সব মিলিয়ে এক মায়াবী আবেশ তৈরি হয়েছিল। মৃত্যু যে তাদের দিকেই নিঃশব্দে এগিয়ে আসছে, তা তারা ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি।
কিন্তু প্রকৃতি যেন মানুষের অহংকার আর রক্তপিপাসা দেখে রুষ্ট হয়েছিল। রাতের গভীরতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আকাশের মুখভার হলো। হঠাৎ মুষলধারে বৃষ্টি নামল। অচিরবতী নদী, যা কিছুক্ষণ আগেও শান্ত ছিল, সেই বৃষ্টিতে যেন রুদ্রমূর্তি ধারণ করল। পাহাড়ের ঢল আর বৃষ্টির জল মিলে নদীর জলস্তর দ্রুতগতিতে বাড়তে লাগল। মুহূর্তের মধ্যে সেই শান্ত নদী এক প্রলয়ঙ্করী মহাপ্লাবনের রূপ ধারণ করল। বাঁধভাঙা জলের স্রোত উন্মত্ত গতিতে কূল ছাপিয়ে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল।
নদীর তীরে স্থাপন করা বিড়ূঢ়ভের বিরাট শিবির, তার তাঁবু, আসবাবপত্র, হাতি, ঘোড়া, সৈন্য – সব কিছু সেই প্রচণ্ড স্রোতের মুখে খড়কুটোর মতো ভেসে যেতে লাগল। ঘুমন্ত সৈন্যরা জেগে ওঠারও সময় পেল না। মৃত্যুপুরীর চিৎকার আর আর্তনাদ সেই প্লাবনের গর্জনে মিলিয়ে গেল। বিড়ূঢ়ভ, যিনি কিছুক্ষণ আগেও নিজের জয় আর শক্তিতে মত্ত ছিলেন, তিনিও সেই সর্বগ্রাসী জলের টানে কোথায় যে তলিয়ে গেলেন, তার কোনো চিহ্ন রইল না। তাঁর সমস্ত অহংকার, সমস্ত বিজয়োল্লাস নিমেষে ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে গেল।
এই ভয়াবহ ঘটনার সংবাদ যখন জগতের সকল জীবের প্রতি করুণাময় ভগবান বুদ্ধের কর্ণগোচর হলো, তিনি তাঁর প্রজ্ঞার আলোকে এই ঘটনার অন্তর্নিহিত সত্য উপলব্ধি করলেন। তিনি দেখলেন কিভাবে মানুষ জাগতিক বিষয়-বাসনায় আসক্ত হয়ে নিজের ধ্বংস ডেকে আনে। তিনি তখন নিম্নোক্ত গাথাটি উচ্চারণ করলেন:
**৪। পুপ্ফানি হেব পচিণন্তং ব্যাসসত্তমনসং নরং,**
**সুত্তং গামং মহোঘো’ব মচ্চু আদায গচ্ছতি। (ধম্মপদ ৪৭)**
**অনুবাদ* অস্থিরচিত্ত পুষ্পচয়নকারী বিষয়-বাসনায় আসক্ত ব্যক্তি মহাপ্লাবনে ভাসমান সুপ্তগ্রামতুল্য মৃত্যুর কবলে পতিত হয়।
**ব্যাখ্যা* ভগবান বুদ্ধ এই গাথার মাধ্যমে এক গভীর সত্য তুলে ধরেছেন। তিনি বলেছেন, যে মানুষ অস্থিরচিত্তে কেবল জাগতিক ভোগবস্তু বা ইন্দ্রিয়সুখের 'ফুল' সংগ্রহ করে বেড়ায় – মালাকার যেমন বাগানে ঘুরে ঘুরে সুন্দর ফুল খুঁজে বেড়ায়, তেমনি বিষয়-বাসনায় আসক্ত মানুষ রূপ, রস, গন্ধ, স্পর্শ, শব্দ ইত্যাদি পঞ্চকাম-বস্তুর পেছনে ছোটে। তারা এক ভোগের পর আরেক ভোগের দিকে ধাবিত হয়, কখনো তৃপ্ত হয় না। তাদের মন থাকে চঞ্চল, কেবল পাওয়ার নেশায় মত্ত। এই ধরনের আসক্ত ব্যক্তি পার্থিব ভোগ্যবস্তুতে এত বেশি জড়িয়ে পড়ে যে তারা জীবনের প্রকৃত সত্য, এর অনিশ্চয়তা এবং মৃত্যুর অবশ্যম্ভাবিতা সম্পর্কে সম্পূর্ণ বেহুঁশ থাকে, যেন তারা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন।
ঠিক যেমন একটি গ্রাম যখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন থাকে, তখন হঠাৎ আসা এক মহাপ্লাবন যেমন সেই গ্রামের নর-নারী, গো-মহিষ সবকিছুকে ভাসিয়ে নিয়ে যায় সমুদ্রে – কেউ বাধা দিতে পারে না, পালিয়ে বাঁচতে পারে না – ঠিক তেমনই বিষয়-বাসনায় আসক্ত ও মোহনিদ্রায় মগ্ন মানুষকে অতর্কিতে মৃত্যু গ্রাস করে। বিড়ূঢ়ভের ঘটনাই এর জ্বলন্ত প্রমাণ। তিনি নিজের ক্ষমতা, বিজয় এবং ভোগবিলাসে এতটাই মত্ত ছিলেন যে তিনি আসন্ন বিপদ বা নিজের কর্মফলের বিষয়ে সম্পূর্ণ অন্ধ ছিলেন। নদীর তীরে সুরার নেশায় বুঁদ হয়ে থাকা তাঁর সৈন্যরা ছিল ঘুমন্ত গ্রামের মতোই অসহায়। প্রকৃতিরূপী মৃত্যু যখন মহাপ্লাবনের মতো আঘাত হানল, তাদের সব কিছু ভেসে গেল।
বুদ্ধের এই গাথা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, জাগতিক ভোগ ও আসক্তি ক্ষণস্থায়ী এবং তা মানুষকে আরও বেশি মোহাচ্ছন্ন করে তোলে। এই মোহনিদ্রাই মানুষকে জীবনের চরম সত্য – মৃত্যু এবং কর্মফল – সম্পর্কে অসচেতন করে রাখে। পরিণামে, বিড়ূঢ়ভের মতো আকস্মিক ও ভয়াবহ পরিণতি অনিবার্য হয়ে ওঠে। তাই, অস্থিরচিত্ততা ত্যাগ করে, বিষয়-বাসনায় আসক্তি কমিয়ে প্রজ্ঞাবান হওয়া এবং জীবন ও মৃত্যুর প্রকৃত স্বরূপ উপলব্ধি করাই শ্রেয়।

image